১. কোরবানি করা প্রধান ইবাদত
কোরবানি করা এই তিন দিনের প্রধান আমল। কেবল ১০ তারিখ নয়, ১১ ও ১২ তারিখেও কোরবানি করা যায়। তবে সর্বোত্তম সময় ১০ তারিখ ঈদের নামাজের পর। ফিকহের কিতাবে এসেছে, প্রথম দিন কোরবানি করা উত্তম। তারপর দ্বিতীয় দিন। তারপর তৃতীয় দিন সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। জিলহজ মাসের ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পর কোরবানি করা শুদ্ধ নয়। (ফতোয়ায়ে আলমগিরি : ৫/২৯৬)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আজ আমরা এই দিনে প্রথমে নামাজ আদায় করি, তারপর কোরবানি করি। যে ব্যক্তি এমনটি করে, সে আমাদের সুন্নাতের অনুসরণ করল।’ (সহিহ বুখারি: ৫৫৪৫)
ফজিলত: হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বলেন, আমরা রাসুল (স.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানি কী? রাসুল (স.) বলেন, এটি তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত। অতঃপর সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! এতে আমাদের জন্য কী প্রতিদান আছে? জবাবে তিনি বলেন, প্রতিটি চুলের বিনিময়ে একটি করে নেকি দেওয়া হবে। অতঃপর সাহাবায়ে কিরাম আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসুল! পশমের বিনিময়েও কি এ পরিমাণ সওয়াব আছে? রাসুল (স.) জবাব দিলেন, হ্যাঁ, প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকি দেওয়া হবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩২৪৭)
২. তাকবিরে তাশরিক বলা (ফরজ নামাজ শেষে)
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন- وَاذۡکُرُوا اللّٰہَ فِیۡۤ اَیَّامٍ مَّعۡدُوۡدٰتٍ ‘তোমরা কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহকে (বেশি বেশি) স্মরণ কর।’ (সুরা বাকারা: ২০৩) ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এখানে اَیَّامٍ مَّعْدُوْدٰتٍ দ্বারা উদ্দেশ্য- আইয়ামে তাশরিক। (সহিহ বুখারি, অধ্যায় ফাদলিল আমাল ফি আইয়ামিত তাশরিক; মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার: ১০৮৭২)
৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আছর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ’ বলা ওয়াজিব। এই সময়ে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর জামাতের সঙ্গে পড়া হোক বা একাকী, ওয়াক্তের মধ্যে পড়া হোক বা কাজা, নামাজি মুকিম হোক বা মুসাফির, শহরের বাসিন্দা হোক বা গ্রামের—সবার ওপর একবার তাকবিরে তাশরিক বলা ওয়াজিব। (দুররে মুখতার: ২/১৮০)
ফজিলত: রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, এই দিনগুলোতে তাকবিরে তাশরিকের আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমল উত্তম নয়। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, জিহাদও কি (উত্তম) নয়? নবী করিম (স.) বলেন, ‘জিহাদও নয়। তবে সে ব্যক্তির কথা ভিন্ন, যে নিজের জান ও মালের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না।’ (সহিহ বুখারি: ৯৬৯)
৩. গরিব-আত্মীয়-প্রতিবেশীর হক আদায় করা
কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করা সুন্নাহ—এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন, এক ভাগ গরিব-মিসকিন, এক ভাগ নিজের পরিবার। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর তোমরা তা থেকে খাও এবং দুঃস্থ, অভাবগ্রস্তকে আহার করাও।’ (সুরা হজ: ২৮) রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘তোমরা কোরবানির গোশত সংরক্ষণ করো, খাও এবং অন্যকে খাওয়াও।’ (সহিহ বুখারি: ৫৫৮৯) এসব দলিলের ভিত্তিতে বিশুদ্ধ ফতোয়ার গ্রন্থগুলোতে বলা হয়েছে, কোরবানির মাংসের এক-তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনকে এবং এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য পুরো মাংস যদি নিজে রেখে দেয়, তাতেও কোনও অসুবিধা নেই। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪,আলমগিরি: ৫/৩০০)
ফজিলত: আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনি আমাকে এমন একটি আমল দেখিয়ে দিন, যা আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে দেবে।’ তখন রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘একমাত্র আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। সালাত কায়েম করবে, জাকাত দেবে ও নিজ আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করবে।’ লোকটি রওনা করলে রাসুলুল্লাহ (স.) তাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘সে যদি আদিষ্ট বিষয়গুলো আঁকড়ে ধরে রাখে, তাহলে সে জান্নাতে যাবে।’ (বুখারি: ১৩৯৬)
৪. কোরবানির দিনগুলোতে রোজা রাখা নিষিদ্ধ
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘রাসুল (স.) ঈদুল ফিতরের দিন ও কোরবানির দিন রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন।’ (সহিহ বুখারি: ১৯৯২; সহিহ মুসলিম: ৮২৭) অনুরূপভাবে তাশরিকের দিনগুলোতে রোজা রাখাও হারাম। তাশরিকের দিনগুলো হচ্ছে- ঈদুল আজহার পরের তিনদিন (১১, ১২ ও ১৩ই জিলহজ)। নবী (স.) বলেছেন, ‘তাশরিকের দিনগুলো হচ্ছে- পানাহার ও আল্লাহকে স্মরণ করার দিন।’ (সহিহ মুসলিম: ১১৪১)
৬. বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করা
এই দিনগুলোতে আল্লাহর জিকির ও শোকর আদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাকবির, তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ)—এসব জিকির পড়া সুন্নত। আল্লাহ বলেন, ‘…যেন তারা নির্ধারিত কিছু দিন আল্লাহর নাম স্মরণ করে…’। (সুরা হজ: ২৮)
কোরবানির এই তিন দিন কেবল পশু জবাইয়ের উৎসব নয়, বরং তা ত্যাগ, ইবাদত ও আত্মিক প্রশান্তির দিন। তাই আসুন, কোরবানির মূল উদ্দেশ্য ও আমলগুলো সঠিকভাবে পালন করে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হই।