মোঃমামুনুর রশিদ : কুমিল্লা–সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কে প্রায় ১০ ঘণ্টাব্যাপী দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর বুধবার রাত ১২টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মিরপুর হাইওয়ে থানা এলাকায় প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানবাহন চলাচল কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে।স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মিরপুর হাইওয়ে থানা এলাকায় একটি পাথরবাহী ট্রাক ও একটি মাছবাহী ট্রাকের ক্রসিংয়ের সময় সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের ফলে পাথরবাহী ট্রাকটির একটি চাকা খুলে মহাসড়কের মাঝখানে পড়ে যায়, এতে সড়কটি সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।এর ফলে দেবিদ্বার ইউসুফপুর থেকে ব্রাহ্মণপাড়া কালামুইড়া ব্রিজ পর্যন্ত শত শত যানবাহন দীর্ঘ সারিতে আটকে যায়। এতে সাধারণ যাত্রী, পরিবহন শ্রমিক ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চরম দুর্ভোগের শিকার হন।
স্থানীয়রা জানান, কুমিল্লা–সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ও যানজটের ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার পেছনের কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন—উত্তর দিক থেকে আসা অবৈধ মাটিবাহী শত শত ড্রাম ট্রাকের বেপরোয়া গতি, ট্রাক থেকে মাটি পড়ে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া, পিচ্ছিল রাস্তায় যানবাহনের স্লিপ করা, সড়কের দুই পাশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে সিএনজি অটোরিকশা পার্কিং এবং যথাযথ পার্কিং ব্যবস্থার অভাব।এলাকাবাসীর দাবি, অবৈধ মাটিবাহী যান চলাচল বন্ধ করা গেলে এই মহাসড়কে যানজট ও দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে। তারা আরও জানান, সম্প্রতি ইউসুফপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মাটিবাহী ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে হাফেজ নামের ছয় বছরের এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে।
এ সময় স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবহন চালকরা অভিযোগ করেন, শামীম দালাল ও ইউসুফ দালালের মাধ্যমে মাটিবাহী ট্রাক, সিএনজি অটোরিকশা, ট্রাক্টর ও ইটভাঙার গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহন থেকে প্রকাশ্যে দিন-রাত টোকেন বাণিজ্য ও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। মামলার ভয় দেখিয়ে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা আদায় করা হলেও কিছু ‘ম্যানেজ করা’ গাড়ির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, অবৈধ মাটিবাহী গাড়ি, ট্রাক্টর ও নাম্বারবিহীন ভারতীয় অবৈধ পণ্যবাহী পিকআপ গাড়ির বিরুদ্ধেও কোনো মামলা দেওয়া হচ্ছে না।
মিরপুর হাইওয়ে থানার ইনচার্জ আক্তার হোসেন জানান, রাত ১২টার দিকে দুটি গাড়ির সংঘর্ষে পাথরবাহী ট্রাকটি মহাসড়কের মাঝখানে বিকল হয়ে পড়ে, ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, রাস্তার সংকীর্ণতা, ওভারলোড এবং বেপরোয়া ওভারটেকিং—এই তিনটি কারণেই মূলত দুর্ঘটনা ঘটে। বিকল গাড়ি সরানোর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
কুমিল্লা থেকে সিলেটগামী যাত্রী তোফায়েল আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
“এই সড়কটি মাত্র দুই লেনের হওয়ায় সামান্য দুর্ঘটনা বা গাড়ি বিকল হলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয়। আজ ১০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বড় শালঘর নতুন বাজার এলাকায় আটকে আছি।”
সিএনজি চালক আলাউদ্দিন জানান, রাত ১২টার দিকে পাথরবাহী ট্রাকটি মিরপুর হাইওয়ে থানার সামনে বিকল হয়ে পড়লেও ৮–১০ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও সেটি পুরোপুরি সরানো সম্ভব হয়নি। এতে সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ে।
এ বিষয়ে মিরপুর হাইওয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফজলুল হক জানান, সড়কটি দুই লেনের হওয়ায় সামান্য দুর্ঘটনা বা যানবাহন বিকল হলেই দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে রেকার আনতে সময় লাগায় গাড়ি সরাতে বিলম্ব হয়েছে। বর্তমানে যান চলাচল স্বাভাবিক করার কাজ চলছে।
এই মহাসড়কের বেহাল অবস্থার কারণে প্রতিদিনই যাত্রী ও চালকদের এমন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী।
🚨 অনুসন্ধানী দৃষ্টিকোণ: অবৈধ মাটি পরিবহন ও ‘দালাল সিন্ডিকেট’-এর অভিযোগ
স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে আরও গুরুতর অভিযোগ। তাদের দাবি, কুমিল্লা–সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কটি কার্যত একটি প্রভাবশালী দালালচক্রের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বিশেষ করে অবৈধ মাটি পরিবহন, ইটভাটার কাঁচামালবাহী ট্রাক ও নাম্বারবিহীন পিকআপ চলাচলের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে স্পষ্ট বৈষম্য দেখা যাচ্ছে।অভিযোগ অনুযায়ী, শামীম দালাল ও ইউসুফ দালালের মাধ্যমে প্রতিদিন শত শত যানবাহন থেকে ‘টোকেন’ দেওয়ার নামে অর্থ আদায় করা হয়। যারা নির্ধারিত অর্থ প্রদান করে, তাদের গাড়ির বিরুদ্ধে ওভারলোড, কাগজপত্র বা রুট পারমিট সংক্রান্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অপরদিকে, যারা অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও হয়রানির অভিযোগ রয়েছে।
পরিবহন চালকদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই টোকেন বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা আদায় হলেও এর কোনো সরকারি রসিদ বা বৈধতার প্রমাণ নেই। এতে একদিকে রাষ্ট্র বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে অবৈধ ও ওভারলোড যানবাহনের অবাধ চলাচলের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত দুর্ঘটনার পেছনে শুধু রাস্তার সংকীর্ণতাই নয়—আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও অবৈধ পরিবহন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতাও বড় কারণ। অবৈধ মাটি পরিবহন বন্ধ, সড়কের দুই পাশে অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদ এবং অভিযোগকৃত দালালচক্রের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া এই মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্থানীয়দের দাবি—দালাল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত, অবৈধ মাটিবাহী যান চলাচল বন্ধ এবং স্থায়ী ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা চালু করা না হলে কুমিল্লা–সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক আরও বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে পড়বে।