রাঙামাটি জেলা প্রতিনিধি : বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের বিভাজনের রাজনীতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী পার্বত্য চট্টগ্রাম — এমন মন্তব্য করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “পাহাড়ে দীর্ঘদিন ধরে নানামুখী বিভেদ ও অশান্তি জিইয়ে রেখে তৃতীয় পক্ষ সুবিধা নিয়েছে। এবার আর তাদের সুযোগ দেওয়া হবে না।” তিনি আরও বলেন, “সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো সমস্যা থাকলে আমরা নিজেরা বসে সমাধান করবো। অন্য কারো হস্তক্ষেপ বা ফায়দা লুটার সুযোগ আর থাকবে না।”
শনিবার দুপুরে রাঙামাটি শহরের বনরূপা চত্বরে আয়োজিত ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’-এর সমাবেশে এসব কথা বলেন তিনি।
নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা যে সংবিধানের কথা বলছি, সেটা ৭২ সালের মুজিববাদী সংবিধান,যেটার আমরা বিরোধিতা করে অাসছি । যে সংবিধানে সকল জনগোষ্ঠীকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি।আমরা এমন একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান চাই, যেখানে পাহাড়ি-বাঙালি—সকল জনগোষ্ঠীর অধিকার সুনিশ্চিত থাকবে।” তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, রাঙামাটির কৃতী সন্তান এমএন লারমা-ও ওই সংবিধানের বিরোধিতা করেছিলেন।
তিনি বলেন, “আমরা চাই, সবাইকে নিয়ে একটি নতুন চুক্তি হোক, যেখানে চাকমা-মারমা-বম-বাঙালি সকল জনগোষ্ঠীর ভাষা, ধর্ম ও ভূমির অধিকার স্বীকৃত হবে। কেউ আর বঞ্চিত হবে না।” তিনি বলেন, বাঙালী জাতীয়তাবাদের নামে এখানে অবাঙালী জনগোষ্ঠীর সাথে বিভেদ তৈরী করে রাখা হয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে এখানে ইসলামের সাথে অন্য ধর্মের বিভেদ তৈরী করে রাখা হয়েছে। আমরা সকল বিভেদের উদ্ধে গিয়ে সকল জনগাষ্ঠীকে মর্যাদা দিয়ে একটি সংবিধান তৈরী করতে চাই।
নাহিত ইসলাম আরো বলেন, আমরা জানি পাাহাড়ের চাকমা, মারমা,তঞ্চঙ্গ্যা বম সহ অন্যান্য জনগোষ্ঠী তাদের ভাষা ধর্ম ভুমির অধিকার নিয়ে লড়াই করছে। অন্যদিকে যারা বাঙালী জাতিগোষ্ঠী রয়েছে তারাও নানান সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তিনি বলেন,আমরা উভয়ই সকল জনগোষ্ঠী এখানে নির্যাতিত এবং অধিকারহীন। তাই আমাদের লড়াইটা একসাথে করতে হবে কাউকে বাদ দিয়ে করা যাবে না।
নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা সেই ঐক্য সেই সম্প্রীতির ও সহানুভূতির কথা বলতে এসেছি।ঐক্য এবং শান্তির রাজনীতি জাতীয় নাগরিক পার্টি করতে চাই। পাহাড়ে যে অশান্তি যে বিভেদ বছরের পর বছর জিইয়ে রাখা হয়েছে। সেই অশান্তি এবং বিভেদকে দূর করতে হবে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং অাঞ্চলিক অখন্ডতা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অামরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করবো। বাংলাদেশকে যেকোন অধিপত্যবাদী শক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হলে বাংলাদেশের সকল সম্প্রদায়কে একত্রে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে।
নাহিদ বলেন,“পাহাড়ের সৌন্দর্য্য ও বৈচিত্র্য আমাদের জাতীয় সম্পদ” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই বৈচিত্র্যকে বিভেদের জায়গা নয়, সম্প্রীতির শক্তি বানাতে হবে। আমাদের লড়াইটা একসঙ্গে হবে—কাউকে বাদ দিয়ে নয়। যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনীতি করেন, তাদের মধ্যেও সৌহার্দ্য চাই।”
নাহিদ ইসলাম বলেন, “আপনারা আপনাদের মাতৃভাষায় সন্তানদের শিক্ষিত করবেন, নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্ম পালন করবেন। এতে রাষ্ট্র বা কোনো বাহিনী বাধা হতে পারবে না।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—সব ধর্মের, সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সমান অধিকার থাকবে। এই বাংলাদেশ হবে আলেম, নারী, পাহাড়ি-বাঙালি সবার।”
সমাবেশে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন এনসিপি নেতা সারজিস আলম
এনসিপির উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম সমাবেশে বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ যেন ব্যবহার না হয়, আমাদের সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।”
একটি পূর্বের বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “সম্প্রতি বান্দরবান নিয়ে আমার একটি মন্তব্য অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল হয়েছে। আমি আজ সেই মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে চাই”
তিনি বলেন, “এই রাষ্ট্র কাঠামোতে কিছু অপচর্চা চলে আসছে। যেমন, শাস্তিস্বরূপ কর্মকর্তাদের বদলি করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বা উত্তরাঞ্চলের প্রান্তিক জেলাগুলোতে। এটা স্থানীয় জনগণের প্রতি অবিচার।” “দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের কোন জায়গা নেই”।
সারজিস বলেন, “কোনো সরকারি কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি নয়, তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এই পাহাড়, এই জীববৈচিত্র্য, এই সংগ্রামী মানুষ আমাদের অহংকার। কেউ যেন সাময়িক সুবিধা দিয়ে এ অঞ্চলের জনগণের অধিকার হরণ করতে না পারে, সেদিকে সকলকে সজাগ থাকতে হবে।”
পদযাত্রা ও সমাবেশ ছিল চার স্তরের নিরাপত্তায় । ‘জুলাই পদযাত্রা’ উপলক্ষে রাঙামাটি শহরে ছিল চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে ছিল পুরো এলাকা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতও মাঠে ছিল।
বনরূপা চত্বরে অনুষ্ঠিত সমাবেশে হাজারো মানুষের ঢল নামে। সেখানে অংশ নেন এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহসহ শীর্ষ নেতাকর্মীরা।
সমাবেশ শেষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় দলীয় নেতাকর্মীদের চট্টগ্রামে পৌঁছে দেওয়া হয়।