নিজস্ব প্রতিবেদক | কুমিল্লা, কুমিল্লার দেবিদ্বারে পৈত্রিক জমি সংক্রান্ত দীর্ঘদিনের বিরোধকে কেন্দ্র করে নতুন করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। মিথ্যা সাধারণ ডায়েরি (জিডি), কাগজপত্র জালিয়াতি এবং বিতর্কিত তদন্ত প্রতিবেদন ঘিরে এলাকাজুড়ে চলছে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেবিদ্বার থানাধীন সাবেক ১২৯ হালে ১৬ নম্বর মুগসাইর মৌজার সিএস ৩৫৫, ২৩৯, ২৩৮ খতিয়ান, আরএস ৩৩৯ এবং বিএস ৬৯৯ খতিয়ানের অধীনে সাবেক ১০৮৪ হালে ২৩৯৮ দাগের ১৫ শতক ভিটিভূমির মালিক ছিলেন মোহাম্মদ নূর। মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে উক্ত ভূমির মালিকানা তাঁর দুই ছেলে তাজুল ইসলাম ও হারুনুর রশিদের কাছে হস্তান্তরিত হয়।
জমিটি দুই ভাগে বিভক্ত হলে তাজুল ইসলাম ও হারুনুর রশিদ প্রত্যেকে ৭.৫ শতক করে অংশীদার হন। পরবর্তীতে তাজুল ইসলামের মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে মো. নুরুল ইসলাম মামুন ও মনিরুল ইসলাম মোমেন উত্তরাধিকারী হন।
হারুনুর রশিদ দীর্ঘদিন এলাকার বাইরে অবস্থান করায় জমির দেখাশোনা করতেন তাঁর ভাতিজা মনিরুল ইসলাম মোমেন। পরে আর্থিক প্রয়োজনে হারুনুর রশিদ তাঁর অংশ থেকে দুই দফায় মোট ৫ শতক বিক্রি করেন। বাকি ১০ শতক জমি দখলে রেখে মনিরুল ইসলাম সেখানে ভাড়াটিয়াদের কাছথেকে অগ্রীম টাকা নিয়ে দোকানঘর নির্মাণ করে ভাড়া আদায় শুরু করেন।
হারুনুর রশিদ যখন তাঁর বাকি ২.৫ শতক জমি দাবি করেন, তখন মনিরুল ইসলাম তা অস্বীকার করে এবং নিজেকে ওই জমির মালিক দাবি করে বিভিন্ন ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করেন। পরবর্তীতে তিনি ২০১৯ সালে কুমিল্লার নিম্ন আদালতে একটি দেওয়ানি মোকদ্দমা (দেওয়ানি মামলা নং–১৪৭/২০১৯) দায়ের করেন।
দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট বিজ্ঞ আদালত রায়ে হারুনুর রশিদের মালিকানা বৈধ ঘোষণা করে মামলাটি খারিজ করে দেন। মনিরুল ইসলাম পরবর্তীতে অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, ৫ম দেওয়ানি আপিল নং–২০৭/২০২১ এ আপিল করলে ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর উচ্চ আদালতও পূর্বের রায় বহাল রেখে মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করেন। ফলে আইনগতভাবে হারুনুর রশিদই উক্ত জমির বৈধ মালিক হিসেবে স্বীকৃতি পান।
এর মধ্যেই মনিরুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী পপি ইসলাম স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহলের প্ররোচনায় নিজেকে উক্ত জমির মালিক দাবি করে দোকানঘরগুলোর ভাড়া আদায়ের চেষ্টা শুরু করেন। অন্যদিকে আদালতের বৈধ রায়প্রাপ্ত মালিক হারুনুর রশিদও দোকানগুলোর ভাড়া দাবি করলে ভাড়াটিয়াদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
উক্ত দোকানঘরে ব্যবসা করেন ডাক্তার লতিফ, পরিমল দাস, কামরুল ইসলাম, রাকেশ সূত্রধর ও অলক সূত্রধর। তাঁরা বলেন, “আমরা জানতে চাই, বৈধ মালিক কে? প্রমাণপত্র যিনি দেখাতে পারবেন, তাকেই ভাড়া দেবো।”
পরে হারুনুর রশিদ ও তাঁর ছেলে ফজলে রাব্বি বিজ্ঞ আদালতের রায়ের কপি ও উক্ত ভূমির বৈধ কাগজপত্র নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। তাঁরা ভাড়াটিয়াদের একত্র করে বলেন “বিজ্ঞ আদালতের আদেশ অনুযায়ী এই ভূমির বৈধ মালিক আমি। আপনারা যদি আমার জায়গায় ভাড়া থাকতে চান, তবে আমার সঙ্গে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করে নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় জায়গা খালি করে দিতে হবে।”
ভাড়াটিয়ারা বিষয়টি ভেবে দেখার কথা বলে কিছু সময় চান। এরপর কয়েক মাসে একাধিকবার একই অনুরোধ জানানোর পর একদিন হারুনুর রশিদ চূড়ান্তভাবে ভাড়াটিয়াদের তিন দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেন। তিনি জানান তিন দিনের মধ্যে চুক্তি না করলে তাঁদের জায়গা খালি করে দিতে হবে।
তখন পাঁচজন ভাড়াটিয়ার মধ্যে চারজন চুক্তিতে সম্মত হন এবং চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু একজন ভাড়াটিয়া, রাকেশ সূত্রধর, অসম্মতি জানান। এ অবস্থায় হারুনুর রশিদ তাঁকে দোকান খালি করার কথা বলেন। কয়েক সপ্তাহ পার হলেও রাকেশ সূত্রধর দোকান খালি না করায় হারুনুর রশিদ ও তাঁর পুত্র আবারও তাঁকে সতর্ক করে দোকান ছাড়ার অনুরোধ জানান।
পরে রাকেশ সূত্রধর বিষয়টি মৃত মনিরুল ইসলাম মোমেনের স্ত্রী পপি ইসলামকে জানালে, পপি ইসলাম ঘটনাস্থলে এসে বিস্তারিত শুনে হারুনুর রশিদ ও তাঁর ছেলেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং মামলার হুমকি দেন বলে তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
পরে ৬ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে পপি ইসলাম দেবিদ্বার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডিতে অভিযোগ করা হয় যে, হারুনুর রশিদ ও তাঁর ছেলে ফজলে রাব্বি ভাড়াটিয়াদের ভয়ভীতি দেখিয়ে দোকান দখলের চেষ্টা করছেন।
ওই জিডির ভিত্তিতে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় দেবিদ্বার থানায় কর্মরত এসআই মো. জামসেদ আলম লিটনকে। তিনি ৯ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে দেবিদ্বার থানার নন-এফআইআর প্রসিকিউশন নং ৭৪/২৫ (ধারা ১০৭/১১৭ সি, ফৌজদারি কার্যবিধি) অনুযায়ী একটি তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, “হারুনুর রশিদ ও তাঁর পুত্রসহ কয়েকজন দোকানগুলো জোরপূর্বক দখল করার চেষ্টা করেছেন এবং শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গের আশঙ্কা রয়েছে।”
এ বিষয়ে হারুনুর রশিদ বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা জিডি ও তদন্ত প্রতিবেদন সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও হয়রানিমূলক। আমি পৈত্রিক ওয়ারিশ সূত্রে এবং বিএস খতিয়ান অনুসারে এই ভূমির বৈধ মালিক। আদালতের দুটি রায়ও আমার পক্ষে রয়েছে। অথচ এলাকার কিছু স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মহল পপি ইসলামকে প্ররোচিত করে এমন মিথ্যা প্রতিবেদন করিয়েছে।”
তাঁর ছেলে ফজলে রাব্বি বলেন, ৫ আগষ্ট ২০২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে “একজন দায়িত্বশীল তদন্ত কর্মকর্তা কীভাবে আদালতের দুটি রায় উপেক্ষা করে এমন অসত্য প্রতিবেদন দিতে পারেন, তা বোধগম্য নয়। আমাদের হয়রানি করার উদ্দেশ্যেই এটি করা হয়েছে। আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও আমাদের বিরুদ্ধে এমন ষড়যন্ত্র অমানবিক।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা ২০১৯ সালে প্রতিপক্ষ মামলা করার পর থেকে জমির ধারে-কাছেও যাইনি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বিজ্ঞ আদালতের রায়ের অপেক্ষায় ছিলাম। ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিলে আমরা আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে চাই।
পক্ষান্তরে প্রতিপক্ষ বিজ্ঞ আদালতের রায় অমান্য করে উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করেন। উচ্চ আদালতও গত ১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে পূর্বের রায় বহাল রেখে মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করেন। আমাদের বৈধ মালিকানার কাগজপত্র থাকার পরেও কার ইশারায়, কোন ক্ষমতার বলে আমাদের বিরুদ্ধে বার বার কেন এমন ষড়যন্ত্র হচ্ছে বুঝতে পারছিনা।
ঘটনাস্থলে অনুসন্ধানে জানা যায়, তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব সাক্ষীর নাম উল্লেখ রয়েছে তাদের মধ্যে অন্তত চারজন বলেন যে তাঁরা কোনো সাক্ষ্য দেননি। বরং তাঁদের নাম তদন্ত প্রতিবেদনে মিথ্যাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “তদন্ত কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করেই এমন প্রতিবেদন করানো হয়েছে বলে আমাদের ধারণা।”
অন্যদিকে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. জামসেদ আলম লিটন বলেন, “জমি-সংক্রান্ত বিষয়ে উভয় পক্ষই সাংঘর্ষিক অবস্থানে রয়েছে। ঘটনা পর্যবেক্ষন করে আমি যা পেয়েছি তাই প্রতিবেদন দিয়েছি। আমি ফেরেশতা নই—ভুল হতে পারে। তবে শান্তি রক্ষার স্বার্থেই এ রিপোর্ট দিয়েছি।”
স্থানীয়দের মতে, আদালতের রায়ে ভূমির মালিকানা স্পষ্টভাবে হারুনুর রশিদের পক্ষে থাকলেও নতুন করে মিথ্যা জিডি ও তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে তাঁকে হয়রানি করা হচ্ছে। তাঁরা প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছেন “এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হোক, যেন প্রকৃত মালিক ন্যায়বিচার পান এবং প্রভাবশালী মহলের চাপে কোনো মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরি না হয়।”