বঙ্গ নিউজ বিডি প্রতিনিধি : আজ ২৩ অক্টোবর ২০২৫, যশোরের বেনাপোল পৌর কমিউনিটি সেন্টারে “আমরা নারী”-এর উদ্যোগে এবং শার্শা উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারটিতে বেনাপোল ডিগ্রি কলেজ ও মরিয়াম মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ের প্রায় পাঁচ শতাধিক ছাত্রী অংশগ্রহণ করেন। অক্টোবর মাস বিশ্বব্যাপী “পিঙ্ক মান্থ” বা স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস হিসেবে পালিত হয়। এ উপলক্ষে শার্শা উপজেলা প্রশাসন, শার্শা উপজেলা কলেজ, শার্শা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, “আমরা নারী” এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান “আমরা নারী রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট”-এর যৌথ উদ্যোগে শার্শা উপজেলা অডিটোরিয়ামে চার ঘণ্টাব্যাপী “স্তন ক্যান্সার সচেতনতা বিষয়ক সেমিনার ও আলোচনা সভা” অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের ক্যান্সার সার্জন ও বিশেষজ্ঞ ডা. বনি আমিন। তিনি বলেন,
“স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি হলো সচেতনতা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং নিজের প্রতি যত্নশীল থাকা। একজন নারী সচেতন হলে উপকৃত হয় তার পরিবার, সমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। সময়মতো রোগ সনাক্তকরণ, সঠিক চিকিৎসা ও ইতিবাচক মানসিকতা—এই তিনটি বিষয়ই জীবন বাঁচানোর সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার।”
বিশেষ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পুষ্টিবিদ ইব্রাহিম ইবু। তিনি বলেন,
“স্বাস্থ্যসচেতন প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাঙ্গন থেকেই ক্যান্সার প্রতিরোধের আন্দোলন শুরু করতে হবে। শিক্ষার্থীরাই হতে পারে সমাজে পরিবর্তনের দূত।”
“আমরা নারী”-এর নির্বাহী সদস্য সিরাজুল ইসলাম বলেন,
“আমরা নারী শুধু একটি সংগঠন নয়, এটি এক মানবিক অনুপ্রেরণার প্রতীক। আমরা প্রত্যেকে যদি সচেতনতার দূত হই, তাহলে ক্যান্সারমুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব।”
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সমন্বয়কারী এম এম জাহিদুর রহমান (বিপ্লব) বলেন,
“আমরা নারী একটি অরাজনৈতিক ও অলাভজনক সামাজিক সংগঠন, যা দীর্ঘদিন ধরে নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসুরক্ষা, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে। এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘আমরা নারী রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ নারীর অধিকার, স্বাস্থ্য, নিরাপদ খাদ্য ও শিক্ষা বিষয়ে গবেষণাভিত্তিক উদ্যোগ পরিচালনা করে। আমাদের লক্ষ্য—প্রতিটি শিক্ষার্থীকে স্তন ক্যান্সার সচেতনতার দূত বা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে গড়ে তোলা, যেন তারা সমাজে সচেতনতার আলো ছড়িয়ে দিতে পারে।”
স্তন ক্যান্সার: একটি প্রতিরোধযোগ্য বাস্তবতা
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৩,০০০ নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, যার অর্ধেকেরও বেশি সময়মতো সনাক্ত না হওয়ায় প্রাণ হারান। দেশের মোট ক্যান্সার রোগীর প্রায় এক-ষষ্ঠাংশই এই রোগে ভোগেন। অথচ নিয়মিত আত্মপরীক্ষা, সচেতনতা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা সম্ভব।
ডা. বনি আমিন তাঁর আলোচনায় বলেন,
“স্তন ক্যান্সার তখনই শুরু হয়, যখন স্তনের কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং টিউমারে পরিণত হয়। নিয়মিত পরীক্ষা ও প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্তকরণই এ রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়।”
স্তন ক্যান্সারের ধাপসমূহ:
১. প্রাথমিক ধাপ (Non-invasive stage): এই পর্যায়ে ক্যান্সার স্তনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। সময়মতো চিকিৎসা নিলে প্রায় শতভাগ রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।
২. পরবর্তী ধাপ (Invasive stage): এ পর্যায়ে ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে, ফলে চিকিৎসা জটিল হয়ে যায়।
ঝুঁকির কারণ:
বয়স, বংশগত ইতিহাস, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, মানসিক চাপ এবং শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা। তবে সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম, ধূমপান-মদ্যপান পরিহার ও মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখলে ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করা যায়।
সতর্কতার লক্ষণ:
• স্তনে গুটি বা ফোলা
• ত্বকে কুঁচকানো বা দাগ
• বোঁটা থেকে অস্বাভাবিক স্রাব
• বোঁটা ভেতরে ঢুকে যাওয়া বা আকার পরিবর্তন
এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
নির্ণয় ও চিকিৎসা:
স্তন ক্যান্সার শনাক্তে ম্যামোগ্রাম, আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও বায়োপসি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে চিকিৎসার সফলতা প্রায় শতভাগ। বর্তমানে সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, হরমোন থেরাপি ও ইমিউনোথেরাপির মাধ্যমে কার্যকরভাবে নিরাময় সম্ভব।
প্রতিরোধ ও সচেতনতা:
সচেতনতা, নিয়মিত পরীক্ষা ও নিজের প্রতি যত্নশীলতা—এই তিনটি বিষয়ই স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধের মূলমন্ত্র। প্রতিটি নারী যদি নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হন, তবে উপকৃত হবে তার পরিবার, সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মও।
ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতায় মিডিয়ার ভূমিকা:
এম এম জাহিদুর রহমান বিপ্লব বলেন,
“স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে গণমাধ্যম একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি শুধু তথ্য প্রচার করে না, বরং সমাজে ইতিবাচক মানসিকতা ও আচরণ গড়ে তুলতে সহায়তা করে।”
গণমাধ্যমের ভূমিকা: ১. সচেতনতা সৃষ্টি: টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র, অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে আত্মপরীক্ষা, ঝুঁকি ও প্রতিরোধ সম্পর্কে জানানো। ২. ট্যাবু ভাঙা: রোগীর গল্প ও চিকিৎসা সফলতার অভিজ্ঞতা প্রচারের মাধ্যমে ভয় ও লজ্জা দূর করা। ৩. প্রাথমিক সনাক্তকরণে উৎসাহ: ইনফোগ্রাফিক, শর্ট ভিডিও ও ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে নিয়মিত পরীক্ষার অভ্যাস গড়ে তোলা। ৪. জননীতি প্রভাবিত করা: নারীস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা অবকাঠামো নিয়ে ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে নীতিনির্ধারকদের উদ্যোগে উৎসাহ প্রদান। ৫. সেলিব্রিটি সম্পৃক্ততা: পরিচিত ব্যক্তিত্বদের সম্পৃক্ত করে প্রচারণাকে মানবিক ও অনুপ্রেরণামূলক করে তোলা। ৬. ডিজিটাল প্রচারণা: হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেইন, ওয়েবিনার ও অনলাইন কনটেন্টের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে অন্তর্ভুক্ত করা।
সর্বোপরি, স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে গণমাধ্যম শুধু সংবাদ পরিবেশক নয়—এটি এক মানবিক সচেতনতার আন্দোলনের সহযাত্রী। নির্ভরযোগ্য তথ্য, ইতিবাচক বার্তা ও ধারাবাহিক প্রচারণার মাধ্যমে গণমাধ্যম এমন একটি সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে, যেখানে প্রতিটি নারী নিজের প্রতি যত্নবান, এবং সমাজ হয়ে ওঠে ক্যান্সার সচেতন।