বরিশাল প্রতিনিধি : ৪ আগস্ট কলেজে এসে প্রতিষ্ঠানের প্যাডের ৬টি সাদা পাতাসহ অনেক কাগজপত্র নিয়ে যান, পরে সব ফেরত দিলেও সাদা পাতাগুলো ফেরত দেননি শিরিন-কলেজ অধ্যক্ষ।
কলেজের দেওয়া প্রস্তাবে ছিল না বিলকিস জাহান শিরিনের নাম। তবু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে তাকেই করা হয়েছে বরিশালের বেগম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মহিলা কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি। এ নিয়ে এখন ক্ষুব্ধ কলেজটির শিক্ষক শিক্ষার্থী অভিভাবকরা। কিভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সভাপতি করে পাঠাল সেই প্রশ্ন তুলেছেন তারা। সিদ্ধান্ত বাতিল না হলে প্রয়োজনে আন্দোলন হবে বলেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী আর অভিভাবকরা। অভিযোগের কোনো সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কাগজপত্র দেখে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম আমানউল্লাহ। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে ফোন দেওয়া হলে এই বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান বিলকিস জাহান শিরিন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছিলেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপি শিরিন। জুলাই বিপ্লবে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর বরিশাল নগরীতে জনগণের ব্যবহারের একটি পুকুর ভরাট করে দখলের অভিযোগ ওঠে তিনিসহ তার পরিবারের বিরুদ্ধে। আওয়ামী শাসনামলেও শিরিনের বিরুদ্ধে ছিল দলের তহবিল তছরুপসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় দলীয় পদ আর কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন, ঝাড়ু মিছিল এমনকি কুশপুত্তলিকা পর্যন্ত দাহ করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। ৫ আগস্টের পর পুকুর দখলের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হলে শিরিনের দলীয় সব পদ-পদবি স্থগিত করে বিএনপি। একই সঙ্গে দেওয়া হয় দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা। গত ১৩ মাসেও সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়নি। এরই মধ্যে গত বছরের জুন মাসে নগরীতে থাকা বেগম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মহিলা কলেজের আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি হন শিরিন। প্রায় ৯ মাস ওই পদে দায়িত্ব পালনের পর পূর্ণাঙ্গ গভর্নিং বডি নির্বাচন প্রশ্নে তাকে সভাপতি পদে না রাখার সিদ্ধান্ত নেয় কলেজের শিক্ষক-অভিভাবকসহ গভর্নিং বডির সদস্যরা। সেই অনুযায়ী ঢাকায় পাঠানো প্রস্তাবনায় তার নামও পাঠানো হয়নি কলেজ থেকে। কিন্তু ৩১ আগস্ট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো এক চিঠিতে দেখা যায়, তাকেই (শিরিন) সভাপতি করে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজ পরিদর্শক মো. আব্দুল হাই সিদ্দিক সরদার স্বাক্ষর করেছেন ওই চিঠিতে। যার স্মারক নং ৮৯০১।
আরও পড়ুন
ডাকসু নির্বাচনে অভিনব কায়দায় ভোট চাচ্ছেন বাম প্রার্থী
ডাকসু নির্বাচনে অভিনব কায়দায় ভোট চাচ্ছেন বাম প্রার্থী
প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে কলেজের উন্নয়নসহ সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকা কমিটির হিতৈষী সদস্য লুৎফর রহমান খান বলেন, ‘জন্মলগ্ন থেকে এই কলেজে গভর্নিং বডির সভাপতি পদে সিংহভাগ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ৫ আগস্টের পর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কমিটি বাতিল করে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করতে বলা হয়। সে সময় সভাপতি হতে নানাভাবে লবিং করেন বিলকিস জাহান শিরিন। বহু লোকজন দিয়ে আমাদের বলান তিনি। তদবিরে অতিষ্ঠ হয়ে তখন তাকে সভাপতি করা হয়। সেই পদে ৯ মাস পালন করেন দায়িত্ব। এরপর পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার সময় এলে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেই পূর্বের রীতি অনুযায়ী সরকারি কোনো কর্মকর্তাকে সভাপতি করার। গভর্নিং বডির সর্বসম্মতি এবং শিক্ষক-অভিভাবকরাও একমত হন এতে। যদিও শিরিন তাকেই সভাপতি করার আবদার করেছিলেন। কিন্তু অন্য সবাই রাজি হননি। পরে বরিশালের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মো. আহসান হাবিবকে (যুগ্ম সচিব) তালিকার ১ নম্বরে রেখে সভাপতি পদে ৩ জনের নাম প্রস্তাব করি এবং সে ব্যাপারে সবাই একমত হন।’
কলেজ অধ্যক্ষ মো. মোকলেচুর রহমান বলেন, ‘গভর্নিং বডির সভাপতি পদে ৩ জনের নাম প্রস্তাব করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাই আমরা। তালিকার এক নম্বরে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের (সার্বিক) নাম রাখা হয়। জানতে পেরে সভাপতি পদে তার নাম পাঠানোর জন্য চাপ দিয়েছিলেন শিরিন। আমি আমার অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে দেই তাকে। পরে গত ৪ আগস্ট কলেজে এসে বিল ফরম, ব্যয় ফরম, চেকবই, চেক রেজিস্টার এবং কলেজের প্যাড থেকে ৬টি সাদা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যান শিরিন। পরে অন্যান্য কাগজপত্র ফেরত দিলেও কলেজ প্যাডের সাদা পৃষ্ঠাগুলো তিনি আর ফেরত দেননি। এরপর তো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সভাপতি করে চিঠি পাঠানো হয়।’ কলেজের দাতা প্রতিনিধি বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র কেএম শহিদুল্লাহ বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা গভর্নিং বডির সদস্যরা সবাই বসেছিলাম। সদস্যদের কেউ সভাপতি পদে শিরিনকে মানতে রাজি নন। বিষয়টি আমরা একাধিক মাধ্যমে উপচার্যকে জানিয়েছি। তারপরও যদি সিদ্ধান্তের বদল না হয় তাহলে আন্দোলনে যাবে কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী অভিভাবকরা।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এএসএম আমানউল্লাহ বলেন, ‘প্রতিদিন এরকম অসংখ্য কাজ করতে হয়। কিভাবে কি হয়েছে তা তো কাগজপত্র না দেখে বলতে পারব না। আরও কয়েকটি মাধ্যম থেকে এই বিষয়ে অভিযোগ এসেছে। আমি বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখব। নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটলে কলেজের চাওয়া অনুযায়ী সমস্যার সমাধান করা হবে।’ পরিচয় না প্রকাশের শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, ‘বরিশাল অঞ্চলের বাসিন্দা বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্যকে দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে ফোন করান শিরিন। পরে প্রচলিত প্রথা ভেঙে তাকে সভাপতি পদে মনোনয়ন দিয়ে চিঠি পাঠায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এ নিয়ে তোলপাড় হওয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই এখন বিব্রত।’ অভিযোগ সম্পর্কে জানতে ফোন দেওয়া হলে পত্রিকার নাম এবং অভিযোগের বিষয়বস্তু শুনে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান দলীয় পদ-পদবি স্থগিত থাকা বিএনপি নেত্রী বিলকিস জাহান শিরিন।