মোহাম্মদ তারেক, বিশেষ প্রতিনিধি : প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ আজ, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি)-এর সাথে “Bridging Science with Communities: Developing a Community-Based Lightning Early Warning System (CB-LiEWS) in Bangladesh” শীর্ষক গবেষণার জাতীয় শেয়ারিং অনুষ্ঠান আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বজ্রপাতজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় জরুরি, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থানীয়ভাবে অভিযোজিত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয় যা বর্তমানে দেশের দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জলবায়ু-সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলোর একটি। গবেষণায় উঠে এসেছে যে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বজ্রপাতে প্রায় ২,০০০ মানুষের মৃত্যু এবং ১,৩০০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে গ্রামীণ কৃষক ও জেলে কমিউনিটির ওপর, বিশেষ করে সুনামগঞ্জসহ হাওর অঞ্চলে।অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আশরাফ উদ্দিন। এছাড়াও এতে অংশ নেন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা, উন্নয়ন সহযোগী, গবেষক এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক এবং ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও)-তে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মো. মোমেনুল ইসলাম।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, “বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে প্রায় ৩০০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে, অথচ দীর্ঘদিন ধরে এটি আমাদের দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। এই গবেষণা বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাসকে বাস্তবভিত্তিক ও কমিউনিটি-কেন্দ্রিক জীবনরক্ষাকারী পদক্ষেপে রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে।” তিনি সতর্কবার্তাগুলো যেন সময়মতো মাঠপর্যায়ে জীবনরক্ষাকারী পদক্ষেপে রূপ নেয়, সে জন্য আন্তঃসংস্থাগত সমন্বয়ের ওপর জোর দেন।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মোমেনুল ইসলাম বলেন, “বিএমডিতে আমাদের বৈজ্ঞানিক তথ্য বজ্রপাতের উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে, কিন্তু কেবল বিজ্ঞানই যথেষ্ট নয়। বজ্রপাতজনিত হতাহতের সংখ্যা কমাতে উন্নত পূর্বাভাসের পাশাপাশি কমিউনিটির আস্থা, সহজবোধ্য যোগাযোগ, শক্তিশালী সমন্বয়ের প্রয়োজন। প্রাথমিক সতর্কতাগুলো যেন সবার কাছে বোধগম্য ও কার্যকর হয়, সে লক্ষ্যে প্রযুক্তি ও অংশীদারিত্ব উন্নয়নে বিএমডি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের কারিগরি নেতৃত্বে এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহায়তায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে যে, বজ্রপাতকে একটি বিপজ্জনক ঝুঁকি হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও, কমিউনিটি পর্যায়ে প্রস্তুতির মাত্রা অত্যন্ত কম। জরিপকৃত পরিবারের অর্ধেকেরও বেশি বজ্রপাতজনিত মৃত্যু বা আঘাতের সরাসরি অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। স্পষ্ট এবং স্থানীয় পূর্বাভাসের সীমিত অ্যাক্সেস, প্রতিক্রিয়া ক্ষমতাকে আরও দুর্বল করে তোলে, প্রায় ৭৭% উত্তরদাতা জানান যে, তারা সতর্কতার সময় (লিড টাইম) সম্পর্কে কিছুই জানেন না। কমিউনিটিতে প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমও খুবই সীমিত। ৯৬% উত্তরদাতা জানান যে, তারা কখনো বজ্রপাত-সংক্রান্ত মহড়ায় অংশ নেননি। এর ফলে বিশেষ করে নারী, যুব, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং স্বল্প-শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রতিরোধযোগ্য ঝুঁকির মুখে বেশি পড়ছেন।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্যে, বাংলাদেশে নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এইছ.ই. হ্যাকন অ্যারাল্ড গুলব্র্যান্ডসেন জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তুলতে প্রমাণভিত্তিক, কমিউনিটি-নেতৃত্বাধীন পদ্ধতি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “জলবায়ু সহনশীলতা একটি যৌথ দায়িত্ব, যা শক্তিশালী জাতীয় নেতৃত্ব, কমিউনিটির অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের ওপর নির্ভরশীল। এ ধরনের গবেষণা আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং জলবায়ু-সম্পর্কিত ঝুঁকি কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণ সরবরাহ করে।”
উন্নয়ন সহযোগীদের পক্ষে ইউরোপীয় সিভিল প্রোটেকশন অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান এইড অপারেশনস (ইকো)-এর প্রতিনিধি মোকিত বিল্লাহ আগাম প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক আগাম সতর্কতা ব্যবস্থায় ধারাবাহিক বিনিয়োগের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “কার্যকর আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে টেকসই বিনিয়োগ এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ওপর অটল মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। এই গবেষণাটি পূর্বাভাসমূলক পদক্ষেপের স্কেলিংয়ের জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি প্রদান করে এবং নিশ্চিত করে যে প্রাথমিক সতর্কীকরণগুলি যেন তাদের কাছে পৌঁছায় যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।”
আবহাওয়া অধিদপ্তর, একাডেমিয়া, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, যুব প্রতিনধি ও কমিউনিটি-ভিত্তিক উদ্যোগের পেশাজীবীদের অংশগ্রহণে একটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বাংলাদেশে বজ্রপাত বিষয়ে সচেতনতা ব্যবস্থা ও সরঞ্জাম জোরদারের ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত স্বল্প পূর্বাভাস সময় যা অনেক ক্ষেত্রে এক ঘণ্টারও কম, সীমিত পর্যবেক্ষণ ও রাডার কাভারেজ এবং প্রযুক্তিগত পূর্বাভাসকে সময়োপযোগী ও কার্যকর সতর্কবার্তা রূপান্তরের দুর্বলতা। দুর্বল সংযোগব্যবস্থা, ডিভাইসের স্বল্পতা, আশ্রয়কেন্দ্রের অভাবের কারনেই প্রত্যন্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো আরও কঠিন হয়ে পড়ে, বিশেষ করে, কৃষক ও জেলেদের ঝুঁকিপূর্ণ সময়েও কাজ চালিয়ে যেতে হয় এর কারনে তারা সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকে। প্যানেল আলোচনায় জোর দেওয়া হয় যে, কার্যকর সমাধান হতে হবে কমিউনিটি কেন্দ্রিক ও উন্নত পূর্বাভাস অবকাঠামোর পাশাপাশি মোবাইলের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল নয় এমন স্থানীয়ভাবে পরিচালিত সতর্কতা ব্যবস্থা এবং শক্তিশালী কমিউনিটি নেতৃত্বের সমন্বয়ে গড়ে তুলতে হবে। এছাড়াও, সারা বছরব্যাপী সচেতনতামূলক কার্যক্রম, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার ম্যাপিং করা, কমন অ্যালার্টিং প্রোটোকল বাস্তবায়ন এবং টিভি, রেডিও, লাউডস্পিকার, সাইরেন, স্কুলভিত্তিক সতর্কতা ব্যবস্থা ও বাজারকেন্দ্রিক লক্ষ্যভিত্তিক বার্তার মতো বহুমুখী যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার করতে হবে যাতে কমিউনিটিভিত্তিক জোরদার সচেতনতা গরে ওঠে।
যদিও ২০১৬ সালে বাংলাদেশে বজ্রপাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তবুও পূর্বাভাসের নির্ভুলতা, সতর্কবার্তা প্রচার এবং কমিউনিটি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এখনো ঘাটতি রয়ে গেছে। এ প্রেক্ষাপটে গবেষণাটি, একটি কমিউনিটি-ভিত্তিক বজ্রপাত আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা (CB-LiEWS) প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে, যা বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাসকে স্থানীয় জ্ঞান ও বিশ্বস্ত যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এতে রিয়েল-টাইম শনাক্তকরণ ও পূর্বাভাস জোরদার করে সতর্কবার্তার লিড টাইম বৃদ্ধি, একাধিক মাধ্যমে স্পষ্ট ও স্থানীয়ভাবে বোধগম্য বার্তা প্রদান এবং কমিউনিটির ভেতরে নিয়মিত প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু