মোহাম্মদ আলী হাজারী : মন্ত্রিপরিষদ সচিব ডঃ শেখ মোঃ আব্দুর রশীদ বলেছেন, জাতীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা এবং আগামী প্রজন্মকে যথাযথভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা শুধু স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে সম্ভব নয়। বরং সমন্বিতভাবে তা সুনির্দিষ্ট সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে করতে হবে। সে জন্যই ৩৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সাথে ‘যৌথ ঘোষণা’ স্বাক্ষর করা হয়েছে ৷ এখন প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ সকল মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করবে। মন্ত্রি পরিষদ বিভাগ দিক নির্দেশনামূলক সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসমূহ কারিগরি সমর্থন নিশ্চিত করবে।
তিনি ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের নিমিত্ত ‘যৌথ ঘোষণা’ বাস্তবায়ন কর্মকৌশল নির্ধারণ সম্পর্কিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় একথা বলেন। খাদ্য উৎপাদন এবং ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট ৫টি মন্ত্রণালয় ও আওতাধীন দপ্তর ও সংস্থাসমূহের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মোঃ সাইদুর রহমানের সভাপতিত্বে সভায় কৃষি, খাদ্য, শিল্প, বাণিজ্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন দপ্তরের প্রধানগণ তাদের নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল নির্ধারণে করণীয় সম্পর্কে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা,
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইউএনডিপি, ইউনিসেফ এর প্রতিনিধিবৃন্দ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও এর আওতাধীন দপ্তর/সংস্থার প্রধানগণ অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সকল ধরনের কারিগরি সহযোগিতা বিষয়ে আলোচনা করেন।
সভায় যে সকল বিষয়াদি অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে আলোচনা করা হয় সেগুলো হলো :
১। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে স্বাক্ষরকারী সকল মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের তদারকি কমিটির মাধ্যমে ‘যৌথ ঘোষণা’ বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা;
২। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তক্তাবধানে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী ফলমূল-শাকসবজির প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ, ক্ষতিকর রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ, তামাক থেকে বিকল্প ফসল চাষে প্রণোদনা প্রদান, কৃষক সহায়তা, বাজার ও মূল্য স্থিতিশীলতা, এবং কোল্ড স্টোরেজ ও পরিবহনসহ ফসল সংরক্ষণের অবকাঠামো উন্নয়ন;
৩। খাদ্য নিরাপত্তা ও ভোক্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে সামনের ও পিছনের অংশে লেবেলিং (Front-of-Package Labeling – FOPL) বাধ্যতামূলক, শিশুদের জন্য অস্বাস্থ্যকর খাদ্য ও পানীয়ের বিপণন সীমিত এবং ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (TFA) সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন;
৪। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নিরাপদ ও পুষ্টিকর মাছ, দুধ, ডিম ও চর্বিহীন মাংস উৎপাদন ও বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা উন্নীত করা; অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন ও রাসায়নিক ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে তদারকি, পরিদর্শন ও প্রয়োগ কার্যক্রম জোরদার করা; স্বল্প-লবণ সংরক্ষণ পদ্ধতি ও রপ্তানির সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গবেষণা, উদ্ভাবন ও নীতি সহায়তা প্রদান;
৫। শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে খাদ্য লেবেলিং ও ভোক্তা সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের সামনের ও পিছনের অংশে (Front-of-Package Labeling) পুষ্টি উপাদান, অ্যালার্জেন, সোডিয়াম, চিনি ও ক্ষতিকর চর্বির তথ্য স্পষ্টভাবে প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা, শিল্পখাত পুনর্গঠন ও প্রণোদনার মাধ্যমে লবণ, চিনি, ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট হ্রাসে খাদ্য পণ্যের পুনর্গঠন (reformulation) উৎসাহিত করা; এবং
৬। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আমদানি ও রফতানি খাদ্যে পুষ্টি মানদণ্ড কার্যকর, উচ্চ চিনি, লবণ ও ট্রান্স-ফ্যাটযুক্ত পণ্য সীমিত করণ, নতুন ধরনের তামাক ও নিকোটিন পণ্য নিয়ন্ত্রণ এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্য ও তামাকজাত পণ্যের ক্ষেত্রে পোর্টে স্ক্রিনিং কার্যক্রম চালু করা।
উল্লেখ্য গত ২০ আগস্ট ২০২৫ তারিখ প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ (যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, আঘাজনিত অসুস্থতা ইত্যাদি) প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতা বৃদ্ধির নিমিত্ত ৩৫ টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ ‘যৌথ ঘোষণা’য় স্বাক্ষর করে। ‘যৌথ ঘোষণা’র মাধ্যমে পাচ দফা প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে বলা হয় স্বাক্ষরকারী মন্ত্রণালয়/বিভাগ নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবে। সমন্বিত সহযোগিতার ক্ষেত্রসমূহ হচ্ছে:
১। নীতি প্রণয়নে অগ্রাধিকার:
সব নীতিতে স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য (Health in all Policies)’ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ কর্মকৌশল ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং নির্ধারণে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার এবং প্রয়োজনবোধে বিদ্যমান নীতিসমূহে সংশোধন;
২। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন:
জাতীয় অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বহুখাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত সাশ্রয়ী (Cost-effective Best Buys) কার্যপন্থা বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ মানব ও আর্থিক সম্পদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা এবং অধস্তন দপ্তর/সংস্থার মাধ্যমে মাঠ পর্যায়সহ সকল স্তরে পরিকল্পিত কার্যক্রম তদারকি, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা;
৩। জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সর্বজনীন অংশগ্রহণ:
অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি ও প্রাসঙ্গিক কার্যক্রম সর্বাত্মক সরকারি (Whole of Government) এবং সর্বাত্মক সামাজিক (Whole of Society) উদ্যোগ গ্রহণ করা যেন সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সক্রিয় ও অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়;
৪। সমন্বয় ও সহযোগিতা:
প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ জাতীয় অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের বহুখাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা সমন্বিত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন এবং সমন্বয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা; এবং
৫। অগ্রগতি পর্যালোচনা:
প্রত্যেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ ‘যৌথ ঘোষণা’র অগ্রগতি নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ করা এবং উল্লেখযোগ্য সফলতা সংবলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা; শনাক্তকৃত চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।