মহিউদ্দিন তুষার : গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী-সচিব দ্বন্দ্বে মন্ত্রণালয়ের কাজ-কর্মে নেমে এসেছে অপ্রত্যাশিত ধীরগতি। সৃষ্টি হচ্ছে জটিলতা। অভিযোগ উঠেছে, কোন কোন ক্ষেত্রে মন্ত্রীকে না জানিয়ে একাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সচিব এবং তা বাস্তবায়নেরও চেষ্টা করছেন তিনি। প্রতিমন্ত্রী-সচিব দ্বন্দ্বে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজেও দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। এই দ্বন্দ্বের নীতিবাচক প্রভাব পড়ছে মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ অধিদপ্তরগুলোসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকান্ডে। জানা গেছে, প্রতিমন্ত্রী-সচিব বিরোধ নিয়ে শুধু গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ই নয়, সচিবালয়ের প্রতিটি দপ্তরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। অতীতে কোনো মন্ত্রণালয়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। দপ্তরের অনেকেরই সতর্ক মন্তব্যÑ প্রতিমন্ত্রীর প্রায় সব বিষয়ে সচিবের বিরোধিতার কারণে কাজের জটিলতা দিনদিন বেড়েই চলেছে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে যায়, সম্প্রতি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত অধিদপ্তরে বেশ কিছু কর্মকর্তার বদলি ও পদায়ন নিয়ে এ দ্বন্দ্বের শুরু। জানা যায়, সচিব বর্তমানে বেইলী রোডস্থ বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশনের দ্বিতীয় তলার সরকারি বাসায় থাকছেন। একই বাসায় বসবাস করতেন একজন নির্বাহী প্রকৌশলী। প্রকৌশলী অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া বাবদ সরকারি রাজস্ব খাতে ২৫ হাজার টাকা জমা দিতেন। ওই প্রকৌশলীকে সরিয়ে সচিব বাসাটি বরাদ্দ নেয়ার পর বাসাটিতে প্রায় ৩ কোটি টাকা খরচ করে কাজ করিয়ে অবৈধভাবে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে পূর্বের নির্ধারিত বাসা ভাড়া কমিয়ে ভাড়া বাবদ বর্তমানে তিনি ৭ হাজার ৫০০ টাকা সরকারি রাজস্ব খাতে জমা দিচ্ছেন। এছাড়া সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনের স্ত্রী পরিচয়ে এক নারীর মামা মো. আব্দুল মান্নানের প্রতিষ্ঠান মান্নান ট্রেড এন্ড এসোসিয়েট-এর মাধ্যমে কাজ পাইয়ে দিতে ওই নারী সরাসরি গৃহায়ণ ও গণপূর্তের বিভিন্ন অধিদপ্তরগুলোতে উপস্থিত হয়ে অনুচিত প্রভাব খাটাচ্ছেন এমন অভিযোগও রয়েছে। তথ্যমতে, কাজী ওয়াছি উদ্দিন ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অতিরিক্ত সচিব হিসেবে যোগ দেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে। ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একই মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে তিনি নিয়োগ পান। তার চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ায় গত ১০ মার্চ তাঁকে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়।
মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের কিছু ‘পকেট প্রকৌশলী’ ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ পদ আঁকড়ে আছেন। এ নিয়ে কয়েক বছর ধরে প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও প্রধান প্রকৌশলীর মধ্যে বিরোধ চলছে। এ ছাড়া প্রতিমন্ত্রী গত এক মাসে ৫-৬ দিন দপ্তরে বসেছেন অল্প সময়ের জন্য। সেই সুযোগে সচিব কর্তৃত্ব বাড়িয়ে নিয়েছেন। তাতে কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, রাজউক, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ নুতন করে কোন বৃহৎ প্রকল্প নিয়ে কাজ করে। কিন্তু দু’তিন বছর ধরে সংস্থাগুলোর হাতে তেমন কোনো প্রকল্প নেই। একাধিক সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের আগ্রহের ভিত্তিতেই প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়। কিন্তু বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের বিরোধের কারণে কোনো সংস্থা বা অধিদপ্তর নতুন প্রকল্প হাতে নিতে আগ্রহ দেখায় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারি দলের একজন সাংসদের সঙ্গে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার এই বিরোধ-সংঘাত কেন? বোঝা যায়, নিজের ক্ষমতা ও প্রভাব ধরে রাখা, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আর স্বার্থের দ্বন্দ্ব হয় তখন এইসব বিষয়গুলো সামনে চলে আসে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী এবং সচিবের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলছে, তার মূল কারণ হচ্ছে মানসিকতা। মন্ত্রী মনে করেন, আমিই মন্ত্রণালয়ের প্রধান। অন্যদিকে সচিব মনে করেন, তিনিই নির্বাহী, কাজেই সব ক্ষমতা তার। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে, দুজনকেই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা দেখাতে হবে। দুজনকেই বুঝতে হবে, জনগণের সেবা করাটাই আসল। তারা মনে করেন, এই দ্বন্দ্ব দূর করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো, সংসদীয় কমিটিগুলোকে কার্যকর করা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী মো. শরীফ আহমেদ ও সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনের সাথে মন্তব্য নেওয়ার জন্য মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তারা মোবাইল রিসিভ করেননি।