এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব।
মহানবীর শ্রেষ্ঠ মুজিযা,মহান রবের শ্রেষ্ঠ দান, মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন
“তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা:)এর জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ”
মিলাদ ও সীরাত দুটি আরবি শব্দ। মিলাদ অর্থ জন্ম আর সিরাত শব্দের অর্থ জীবনচরিত। সুতরাং মিলাদুন্নবী (সা.) অর্থ নবীজির জন্ম আর সীরাতুন্নবী (সা.) এর অর্থ নবীজির জীবনচরিত। নবীজির শুভ বেলাদাত বা জন্মকে স্মরণ করে যে অনুষ্ঠান হয় তাকে মিলাদুন্নবী (সা.) মাহফিল বলা হয়। আর নবীজির জীবনচরিত আলোচনার জন্য যে অনুষ্ঠান তাকে সীরাতুন্নবী (সা.) মাহফিল বলা হয়।
মিলাদুন্নবী (সা.) শিরোনামে যে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় সেখানে যে শুধুই রাসূলে পাক (সা.) এর জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা হয় তা নয়, বরং সেখানে তাঁর মিলাদসহ জীবনচরিতের বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়। একইভাবে সিরাতুন্নবী (সা.) শিরোনামে যে সেমিনার হয় সেখানে রাসূলে পাক (সা.) এর জন্মবৃত্তান্তকে বাদ দিয়ে জীবনচরিত আলোচিত হয় না বরং জন্ম থেকে শুরু করে পুরো জীবনীই আলোচনা করা হয়।
একজন মুসলমানের ঈমানের দাবি হলো প্রিয়নবী (সা.) এর স্মরণে তাঁর গোটা জীবনকে ভরিয়ে রাখা। ইশকে রাসূল (সা.) যার মধ্যে সক্রিয় সে ব্যক্তি শয়নে-স্বপনে, নীরবে-সরবে, অন্তরে-বাইরে, কথায়-কাজে, লেখনীতে-বক্তৃতায়, একাকী-মাহফিলে সর্বদাই তাঁর প্রিয়তম রাসূলের স্মরণে ব্যাপৃত থাকে।
আশেক মজনুকে কেউ মরু বালুকার ওপর লাইলির নাম লিখতে দেখে বলেছিলেন, তুমি নির্বোধের মতো বালুর ওপর নাম লিখছ, এটা তো একটা বাতাস এলেই মিটে যাবে। তখন সে জবাব দিয়েছিল, সেটা আমিও জানি। তবে আমি এটা করছি আমার অন্তরকে প্রবোধ দেয়ার জন্য। আসলেই অস্থির প্রেমিক-হৃদয় প্রেমাস্পদের স্মরণে একটু শান্তির সন্ধান খুঁজে পায়। তাই সে তার প্রেমাস্পদকে স্মরণ করার বাহানা খুঁজে বেড়ায়। খোদ আল্লাহ রব্বুল আলামিন যেই নবীজিকে প্রেমাস্পদ উপাধিতে ধন্য করেছেন, যার মনোতুষ্টির ঘোষণা দিয়েছেন, যার স্মরণকে সুউচ্চ করেছেন সেই নবীর উম্মত হতে পেরে প্রতিটি মুমিন হৃদয় ধন্য, প্রতিক্ষণে তার স্মরণে উন্মুখ।
রাসুলুল্লাহকে (সাঃ) অনুসরণ করা, তাঁকে ভালোবাসা উম্মতের জন্য ইবাদত। তা যদি নাও হতো আর এর ফজিলতের ঘোষণা নাও থাকত তারপরও প্রকৃত মুমিন তাকে অনুসরণ না করে থাকতে পারত না।
রাসুলুল্লাহ (সা:) অনুসরণকে বিশেষ কোনো পদ্ধতির মধ্যে সীমিত করা সঙ্কীর্ণ মানসিকতার পরিচায়ক। তবে একথাও অনস্বীকার্য যে, তাকে স্মরণ করতে গিয়ে এমন কিছু করা যা তার শিক্ষা ও আদর্শের পরিপন্থী অথবা এমনভাবে স্মরণ করা যাতে বিজাতীয় কৃষ্টি-কালচার অনুসরণ করা হয়, এটা নিঃসন্দেহে অনুমোদনযোগ্য নয়।
এটা প্রকৃতপক্ষে তার অনুসরণ নয়। কারণ তাঁর অনসরণ তো তার ভালোবাসাকে জাগরুক করবে, তার নীতি-আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তুলবে। তার অনুসরণ অনুকরণে ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধ করবে। যে অনুসরণের মধ্যে এটা অনুপস্থিত সে অনুসরণ নিছক মেকি এবং প্রহসনের নামান্তর। সুতরাং রাসূল (সা:) এর অনুসরণ, তার মিলাদুন্নবী (সা:) অনুষ্ঠান আর সীরাতুন্নবী (সা.) অনুষ্ঠান যেভাবেই হোক না কেন তা যেন মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত না করে এ বিষয়ে আমাদের সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
মিলাদুন্নবী আর সিরাতুন্নবী নিয়ে দ্বন্দ্ব করা কি রাসূলে পাক (সা.) এর শিক্ষা ও আদর্শ, নাকি তাঁর স্মরণ ও ভালোবাসার প্রমাণ?
মিলাদুন্নবী বা সীরাতুন্নবী (সা.) যে নামেই হোক না কেন, আমাদের লক্ষ্য থাকতে হবে দুটি। একটি হচ্ছে রাসূল (সা.) এর ভালোবাসায় আমাদের ঈমান তেজোদ্দীপ্ত করা এবং অন্তর আলোকিত করা। অপরটি রাসূল (সা.) এর আদর্শ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণের জ্ঞান আহরণ এবং তা বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত করা।
রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি (রাসূল) তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে প্রিয়তম না হই’।নবীজির ভালোবাসা লাভ করতে হলে তাঁকে ভালোভাবে জানতে হবে। তিনি যে মহান আদর্শ নিয়ে বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন, তা হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। তবেই তাঁকে ভালোভাবে জানতে পারব এবং তখনই তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসা যথার্থ হবে। এজন্যই প্রয়োজন তার জীবনী বা সিরাত নিয়ে আলোচনা।
দুঃখজনক হল, আমাদের মতভেদ কোথাও কোথাও ফেতনা ও ব্যক্তিগত আক্রোশের রূপ পরিগ্রহ করে। মুসলিম উম্মাহর জন্য এটা অবশ্যই কল্যাণকর নয়। তাই আহ্বান থাকবে, আমরা যেন সবাই একটু সহনশীল ও উদার মানসিকতার পরিচয় দিতে পারি। সিরাত ও মিলাদ নিয়ে অহেতুক দ্বন্দ্ব করে মুসলিম উম্মাহকে আরও বিভক্ত হতে প্ররোচিত না করি।
-এইচ এম গোলাম কিবরিয়া রাকিব।
প্রতিষ্ঠাতা:মাওলানা আব্দুল হাকিম (রহ:)ফাউন্ডেশন, কুমিল্লা।