নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ এখনো একটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত নয়—যদিও ভূমিকম্পের ঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছে। সম্প্রতি মিয়ানমার ও নেপালে পরপর কয়েকটি ভূমিকম্প এই অঞ্চলের জন্য এক ভয়াবহ সতর্কবার্তা হয়ে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) এবং বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির যৌথ আয়োজনে “Recent Earthquakes in Myanmar and Nepal: Earthquake Concerns for Bangladesh and Way Forward” শীর্ষক এক বিশেষ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শনিবার বিকাল ৫টায় রাজধানীর রমনায় আইইবি সদর দফতরের সেমিনার কক্ষে এ অনুষ্ঠান হয়। এতে দেশি-বিদেশি ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীরা অংশগ্রহণ করেন।
‘ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে হবে এখনই’ — রাজউক চেয়ারম্যান
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইইবি প্রেসিডেন্ট ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম (রিজু) বলেন,
“আমরা ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে বাস করলেও তা নগর নকশা, ভবন নির্মাণ বা জনসচেতনতায় যথেষ্ট প্রতিফলিত হচ্ছে না। ভূমিকম্প প্রতিরোধে এখনই সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দরকার।”
তিনি বলেন, শুধু ঢাকায় নয়—চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় ভবন নির্মাণে বিশেষ সতর্কতা ও আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে।
‘জরুরি ভিত্তিতে রেট্রোফিটিং দরকার’ — বুয়েট অধ্যাপকদের মত
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহমিদ এম. আল-হুসেইনী। তিনি বলেন,
“ঢাকার মাটি মূলত নরম ও অবিচল নয়। ভূমিকম্প হলে এমন মাটিতে নির্মিত অনেক ভবন ধসে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। প্রায় ৭০ ভাগ ভবনের নকশায় ভূমিকম্প প্রতিরোধের বিষয়টি উপেক্ষিত।”
অধ্যাপক রাকিব আহসান ও অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গির আলম বলেন, রাজধানীর বহু সরকারি ভবন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ভূমিকম্প সহনীয় কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব ভবনের রেট্রোফিটিং (পুনর্গঠন) এখনই জরুরি।
এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (AIT), থাইল্যান্ড থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান Prof. Pennung Warnitchai। তিনি বলেন, “ডেটা সংগ্রহ, ভূমি কম্পন বিশ্লেষণ ও সেন্সরভিত্তিক পূর্বাভাস ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে এগোতে হবে।”
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সচেতনতা ও পরিকল্পনার ঘাটতি
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক জনাব রেজওয়ানুর রহমান। তিনি বলেন,
“প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির পাশাপাশি দুর্যোগকালীন রেসপন্স ব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। স্কুল, কলেজ, হোস্টেল—সবখানে সিমুলেশন ও মহড়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।”
আইইবি’র সম্মানী সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. প্রকৌশলী মো. সাব্বির মোস্তফা খান বলেন, “শুধু নীতিমালায় নয়—কারিগরি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও বাস্তব প্রয়োগে ভূমিকম্প প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।”
মুক্ত আলোচনায় উঠে আসে বাস্তবতা ও করণীয়
সেমিনারে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন প্রকৌশলী এম. আব্দুল আউয়াল, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান, অধ্যাপক এম. এ. আনসারি, জনাব আব্দুল লতিফ খান, ও ড. আলী আকবর মল্লিক। আলোচনায় তারা বলেন, ভূমিকম্প মোকাবিলায় পরিকল্পনা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, বাস্তবায়ন তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি।
অধ্যাপক তাহমিদ আল-হুসেইনী বলেন, “কোনো নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় নয়, বরং একটি সমন্বিত জাতীয় টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে।”
সেমিনারে আলোচকরা নিম্নোক্ত প্রস্তাব তুলে ধরেন:
প্রতিটি নতুন ভবনের অনুমোদনে ভূমিকম্প সহনীয় ডিজাইন বাধ্যতামূলক করা
পুরাতন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের জরিপ ও পুনর্গঠন
ভূমিকম্প ঝুঁকির এলাকা ভিত্তিক মানচিত্র তৈরি ও তা নগর পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত
স্কুল, অফিস ও আবাসিক এলাকায় মহড়া ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কঠোর করা
সেমিনারের সভাপতি অধ্যাপক তাহমিদ আল-হুসেইনী বলেন,
“ভবিষ্যতের একটি দুর্যোগ যেন আমাদের উন্নয়নকে ধ্বংস না করে দেয়, সেই প্রস্তুতি আজ থেকেই নিতে হবে।”