কেউ কেউ পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আবার ছোট ছোট দলগুলো বিএনপির বিরুদ্ধে অবমূল্যায়নের অভিযোগও তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব কমাতে নিয়মিত বৈঠক করার কথা জানিয়েছে একাধিক শরিক দল। ‘শক্তি সঞ্চার’ করে নতুন কর্মসূচি নিয়ে আবারও একসঙ্গে মাঠে নামতে চান তারা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
অবশ্য বিএনপি নেতাদের দাবি, সরকারবিরোধী আন্দোলনে ৬৩ সমমনা রাজনৈতিক দল আন্দোলনে মাঠে আছে। জাতীয় নির্বাচনের পর গণতন্ত্র মঞ্চসহ আরও কয়েকটি শরিক দলের সঙ্গে একবার বৈঠক হয়েছে। রমজান, ঈদের পর এখন দাবদাহ চলছে। যে কারণে নিয়মিত বৈঠক করা যায়নি। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে সব মিত্র রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আবারও বৈঠক করা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন নেতা বলেন, বিএনপি ও সমমনাদের আন্দোলন সাময়িকভাবে কিছুটা ধীরগতিতে চলছে। একদফার আন্দোলন ঘোষণা হওয়ার পর থেকে নির্বাচনকালীন সময় পর্যন্ত নানা বিষয় নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকরা পর্যালোচনা করছেন। সমমনা দলগুলোও একই কাজ করছে। এজন্য কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে আগামীদিনের কর্মসূচি চূড়ান্ত করার আগেই সমমনাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের মতামত গ্রহণ করবে। বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখার সুযোগ নেই। তারা গণতান্ত্রিকভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। সূত্রমতে, যুগপত আন্দোলনে না থাকলেও একই দিনে একই কর্মসূচি দিয়ে মাঠে ছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
বিএনপির ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত এই দলটি প্রথমে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ নিয়েও বিএনপির সঙ্গে ফের দূরত্ব তৈরি হয়। পরে এ নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে জামায়াতে একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয়। পরবর্তী সময়ে জামায়াত তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দলটির হাইকমান্ড অন্য শরিকদের সঙ্গে কথা বলেননি। যে কারণে শরিকরা অসন্তুষ্ট। এছাড়াও জাতীয় নির্বাচনের পর কোনো কর্মসূচি নিয়েই শরিকদের মতামত নেওয়া হয়নি। শুধু উপজেলার ভোট বর্জনে লিফলেট বিতরণের বিষয়ে সমমনা দুটি জোট ও কয়েকটি মিত্র দলের সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র নেতারা কথা বলেছেন। সব মিলিয়ে যুগপত আন্দোলনে থাকা বিএনপি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয় বলা যায়।
তবে বিএনপি ও সমমনাদের কেউ কেউ দাবি করেছেন, কয়েকজন নেতা সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে চলছেন। তাদের বিষয়ে বিএনপি হাইকমান্ডের কাছে সুস্পষ্ট তথ্য রয়েছে। আন্দোলনকালীন সময়ে বিএনপির বিভিন্ন কৌশলের তথ্য সরবরাহ করেছেন তারা। এখন তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যে কারণে কিছুটা সময় নিচ্ছে বিএনপি। তবে পৃথকভাবে দল ও জোটগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএনপির অন্যতম মিত্র লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, নির্বাচনের পরে দলীয়ভাবে কোনো বৈঠক এখনও হয়নি। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো কর্মসূচিও নেই। কারণ রোজা গেল, ঈদ গেল, পরে প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। অবশ্যই আমরা একসঙ্গে আছি, কোনো দূরত্ব নেই। কর্মসূচি যখন আসবে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একসঙ্গে পালন করব।’
বিএনপির মিত্রদলগুলোর অনেকেই বলছেন, ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে বিএনপির সঙ্গে যুগপতভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছে সমমনা দলগুলো। একদফার আন্দোলন ঘোষণার পর দলগুলোর মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। তখন নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। কর্মসূচি নির্ধারণের আগে দলগুলোর লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক হতো। নেতাদের মূল্যায়ন ছিল। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির সঙ্গে সমমনাদের বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তেমন একটা যোগাযোগ নেই। কয়েকটি দল ও জোটের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখলেও ছোট দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে না। এতে অনেকের মধ্যে এক ধরণের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। কেউ কেউ বলছেন, সরকারবিরোধী প্রতিটি কর্মসূচিতে সমমনা নেতারা অংশ নিয়েছেন। ঢাকা ও ঢাকার বাহিরে ভোট বর্জন আন্দোলনকে গতিশীল করতে ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো কর্মসূচি না থাকায় অনেকেই অলস সময় পার করছেন।
মিত্র দলগুলোর বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে জানান, একদফার যুগপত আন্দোলন নিয়ে নেতাকর্মীরা আশাহত। নির্বাচনের পরে সমমনা দলগুলো ক্রমইে গুরুত্ব হারাচ্ছে। কেউ কেউ নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচিতেও নিষ্ক্রিয় থাকছেন। এতে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়ার শঙ্কায় আছেন মিত্ররা।
তবে বিএনপির সঙ্গে বেশ কয়েকটি ইসলামিক দলের সম্পর্কের উন্নতি ঘটছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্যে ইসলামিক দলগুলো নিজেদের মধ্যেও বন্ধন তৈরিতে মরিয়া। মত-মতান্তর ভুলে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন তারা। সম্প্রতি সময়ে বিএনপি-জামায়াতের সর্ম্পক আরও দৃঢ় করতে কেন্দ্রীয় নেতারা কাজ করছেন বলেও একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।
বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতা ও দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, সমমনা দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আগের মতোই আছে। যোগাযোগও হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে বসা হয়নি। তাদের সভা-সমাবেশে আমরা যাচ্ছি। আমাদের কর্মসূচিতে তারা অংশ নিচ্ছেন। সব মিলিয়ে সর্ম্পক ভালো আছে।
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ১৩ জানুয়ারির পর আনুষ্ঠানিকভাবে লিয়াজোঁ কমিটির কোনো সভা হয়নি। বিএনপি তাদের মতো করে নানা কর্মসূচি দিচ্ছে। গণতন্ত্র মঞ্চ স্বতন্ত্রভাবে কিছু কিছু কর্মসূচি দিচ্ছে। তবে বিএনপির সঙ্গে আমাদের অনানুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ আছে। আলাপ-আলোচনা চলছে। আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা লিয়াজোঁ কমিটি বসে আন্দোলন কর্মসূচি এখনো নিতে পারিনি। আশা করি বিএনপি আন্দোলনের রিভিউটা শেষ করলে হয়তো আমাদের সঙ্গে বৈঠক হবে। এরপর হয়তো কিছু কর্মসূচি যৌথভাবে নিয়ে আসতে পারব।
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, একতরফার নির্বাচনের পরেও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক আগের মতোই আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১২ দলীয় জোটের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক না হলেও যোগাযোগ আছে। তার অংশ হিসাবে বিএনপির সঙ্গে আমরাও উপজেলা নির্বাচন বর্জন করছি। নানা ইস্যুতে কর্মসূচি পালন করছি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, রাজনৈতিক দল হিসাবে রাজনৈতিক সম্পর্ক সব সময় ছিল, এখনো আছে। তবে একটু ভিন্ন মাত্রা হচ্ছে আমরা জোটে ছিলাম। রাজনৈতিক দল হিসাবে সম্পর্ক কখনো বাড়বে, আবার কখনো কমবে। রাজনীতি হিসাবে এটা স্বাভাবিক বিষয়। গেল আন্দোলনেও একসঙ্গে ছিলাম, সম্পর্ক আছে। দুদলের মধ্যে বিভিন্ন দাওয়াতেও অংশগ্রহণ করছি।



