প্রতিবেদক:কাজল | গাজীপুর | ৭ আগস্ট ২০২৫ গাজীপুরের প্রাণকেন্দ্রে ঘটে গেল এক ভয়াবহ ও নজিরবিহীন সহিংসতা—যেখানে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুই সাংবাদিক নির্মম হামলার শিকার হয়েছেন। এক সাংবাদিককে মিটফোর্ড স্টাইলে’ পাথর ছুঁড়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়, আরেকজনকে, ‘প্রতিদিনের কাগজ’-এর রিপোর্টার তুহিনকে, প্রকাশ্যে জবেহ করে হত্যা করা হয়।
ঘটনাটি শুধু গাজীপুর নয়—পুরো বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সকল মহল থেকে একযোগে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে।
পরিকল্পিত হামলা: একজন আহত, একজন নিহত স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল বিকেলে চান্দনা চৌরাস্তা সংলগ্ন এলাকায় প্রথম হামলার শিকার হন এক সাংবাদিক। তাকে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে একদল দুর্বৃত্ত বেপরোয়া ভাবে পাথর ছুঁড়ে তার হাত ও পা ভেঙে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওটা কোনো সাধারণ মারামারি ছিল না। মনে হচ্ছিল, যেন কাউকে চরম শিক্ষা দিতেই এমন ভয়াবহ কায়দায় আক্রমণ করা হয়েছে।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই, মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে কাছাকাছি এলাকায়—চান্দনা চৌরাস্তার ব্যস্ত জনপদেই—প্রকাশ্যে জবেহ করা হয় রিপোর্টার তুহিনকে। তিনি ‘প্রতিদিনের কাগজ-এর গাজীপুর প্রতিনিধি ছিলেন। হামলাকারীরা প্রকাশ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে নির্মমভাবে হত্যা করে।
এটি শুধু সাংবাদিক হত্যাই নয়, এটি মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত দেশজুড়ে সাংবাদিক সমাজ, নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই বর্বর ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলছে—এই হামলা শুধু ব্যক্তির ওপর নয়, এটি একটি রাষ্ট্র ও সমাজের বিবেকের ওপর আঘাত। এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারের বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর বার্তা।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে: আজ যদি একজন সাংবাদিককেও রক্ষা করতে না পারি, তবে আগামীকাল কেউ নিরাপদ নয়। এভাবে সত্যের কণ্ঠরোধ করা যাবে না।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস ও IFJ-এর বিবৃতি
ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংগঠন Reporters Without Borders (RSF)এবং International Federation of Journalists (IFJ)গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। RSF-এর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এক বিবৃতিতে বলেন:
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা প্রশ্নে এমন সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য। দোষীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানবাধিকারের অংশ, যা রক্ত দিয়ে কেনা হয়নি, বরং রক্তে রক্ষা করতে হচ্ছে।
তদন্ত চলছে, এখনো গ্রেপ্তার হয়নি কেউ
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ঘটনাস্থল থেকে জব্দকৃত ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তবে এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। পুলিশের দাবি, তদন্ত চলছে, দ্রুতই মূল হোতাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
আজ তুহিন, কাল আমি: সাংবাদিকদের বিক্ষোভ ও কর্মসূচি ঘটনার প্রতিবাদে আজ সারাদেশে সংবাদকর্মীরা কালো ব্যাজ ধারণ করেছেন। আগামীকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে JusticeForTuhin ও SaveJournalists ট্রেন্ড করছে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও নাগরিকদের প্রশ্ন
এই নৃশংসতার পর দেশবাসীর একটাই প্রশ্ন—সাংবাদিকরা যদি নিরাপদ না হন, তবে তথ্য আসবে কোথা থেকে? রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব হলো নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া। আর সাংবাদিকরাই সেই নাগরিক, যারা বাকিদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেন, দুর্নীতি উন্মোচন করেন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে কলম ধরেন।
গাজীপুরের এই ঘটনা শুধু দুজন সাংবাদিকের ওপর হামলা নয়—এটি পুরো গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকতার পেশার অস্তিত্বের ওপরই এক অশনিসংকেত। এখনই যদি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে সত্য বলার সাহস হারাবে বহু তরুণ রিপোর্টার। আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদেরই গণতন্ত্র।
সারা দেশ ও বিশ্ববাসী আজ এক হয়ে বলছে: তুহিনের রক্ত বৃথা যাবে না। সত্যের কণ্ঠ কখনও রোধ করা যায় না।
✍️ রিপোর্ট: কাজল | সহ-সংগ্রাহক: স্থানীয় সংবাদদাতা, গাজীপুর